বাক্‌ ১০৯ : আবেশ কুমার দাস



কুকুর
  
এক নম্বরের উইকেটটা তাহলে পড়ল এতদিনে। এবার বাকি থাকল খালি দু’ নম্বর।
          নিজে তো ক্রিকেটটা খেলেছিস অনেক দূরলাস্টে নট আউট রয়ে যেতে হয় একজনকে জানিস না?
          সে আট-দশ নম্বরের দিকে কেউ একটা থাকে জেনারেলি।
          আর যখন ব্যাট ক্যারি করে ওপেনার?
          আর কিছু না বলতে পেরে হেসেছিল প্রণয়। পাশ থেকে বলে উঠেছিল স্বাতী, না না, ইয়ার্কি নয় ইন্দ্রদা। এবারে সেরেই ফেলো। আরে আমরাও তো সাজব একটা দিন। বুড়ি হয়ে যাব যে এরপর...
          কুলচাটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে তখন হাসছে ইন্দ্রজিৎ, ভাবছি ব্যাট ক্যারিই করব গাভাসকারের মতো...
          প্রণয় আর স্বাতীই শুধু নয়—ইন্দ্রকে সামনে পেয়ে সারা সন্ধে সেদিন ওই এক প্রসঙ্গ সবার মুখেই। অচিন্ত্য, রক্তিম, দেবাশিস—অনেকেই এসেছিল তনয়ের বউভাতে। স্কুলের পুরনো বন্ধুদের কাউকে বোধহয় বাদ দেয়নি ছেলেটা। আর আজকাল তো সকলেই ব্যস্ত। এমন পালাপার্বণ বাদে বড় একটা দেখা হওয়ারও জো থাকে না কারও সঙ্গে কারও। বিয়ের পর্বও খতম হয়ে এল প্রায়। এখন চলছে ছেলেমেয়েদের মুখেভাতের পালা। বন্ধুদের মধ্যে আশ্চর্যভাবে এতকাল বাকি পড়ে ছিল শুধু ওই ফার্স্ট আর সেকেন্ড বয়ই। জুনের শেষাশেষি বিয়ে হয়ে গেল শেষমেশ তনয়েরও। মধ্য চৌতিরিশের ইন্দ্রকে চেপে ধরারই কথা এবার বাদবাকিদের। আর দু’দিন পরে দেখা হলে তনয়ও ডায়লগ দেবে এরপর। সবাই ধরেই নিয়েছে অনেক দেখেও বোধহয় মেয়ে পছন্দ হচ্ছে না ইন্দ্রর।
          বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁতে ব্রাশ ঘষতে ঘষতে মাসখানেক আগের সেই সন্ধেটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল ইন্দ্রর। একেই বোধহয় বলে মানুষের মন। কোন প্রসঙ্গ থেকে যে কখন কোথায় ভেসে যাবে লেখাজোখা নেই কিছুই। মুহূর্তখানেক আগেও কে ভাবতে পারছিল রবিবারের একটা ছিমছাম সকালের শুরুয়াৎ হবে এভাবে! যদিও রবিবারের আর আলাদা কোনও তাৎপর্যই নেই তার আজকের জীবনে। কিন্তু তবুও রবিবার বলেই না ঘটল ঘটনাটা। তাতে তো সন্দেহই নেই কোনওহপ্তার অন্যদিন হলে কি নেড়ি কুকুর নিয়ে সকাল সকাল এমন কুরুক্ষেত্র বাধতে পারত তীর্থদার বাড়ি! তীর্থদার অফিসের তাড়া থাকত। বাবানকে খাইয়ে গুছিয়ে স্কুলবাসে তুলে দিয়ে আসার চাপ থাকত রমাবউদিরও। খিড়কির একফালি প্যাসেজে কুকুর ঢুকে বসে রইল নাকি ঘোড়ায় ডিম পেড়ে গেল দেখার ফুরসত থাকত কারও!
          আর তাহলে কি দিনটাও শুরু হত এসব চিন্তা নিয়ে! আচমকা খেয়াল হয় ইন্দ্রর, গতরাতের বাসি দাঁতগুলোর ওপর ব্রাশের ঘর্ষণের গতিটা ঝিমিয়ে এসেছে কখন অজান্তেই। আবার তাড়াতাড়ি হাত চালাতে লাগে সে। বেসিনের সঙ্গে লাগোয়া আয়নায় চোখ পড়ে যায়। ব্রাশ করা অবস্থায় কেমন বিকৃত দেখায় মুখখানাকে! ভরাট মুখও যেন সামনের দিকে ছুঁচোলো দেখায় এই সময়। চোখ নামিয়ে নেয় ইন্দ্র। কতদিন আয়নার সামনে দাঁড়ানো হয় না আর আগের মতো! দেড় বছর আগের কেনা ফেসওয়াশের টিউব খালি হয়নি এখনও। দু’দিন অন্তর ক্লিন শেভ করার অভ্যেস ছিল এককালে। আর সেদিন কিনা ফেসবুকের সেই স্ট্যাটাসটায় লাইক দিল সেই মানুষটাই—‘একদিন হেরে গিয়ে যারা বুট ছেড়ে চটি পরে তাদের সম্মান করি। একদিন জিতে গিয়ে যারা চটি ছেড়ে বুট পরে তাদের করুণা করি।’
          লাঠি গোছের একটা কিছু নিয়ে কুকুর তাড়াতে নেমেছে তীর্থদা। বউদিও রয়েছে ধারেকাছেই। গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে দু’জনেরই।
          বেশি কাছে যাবে না কিন্তু। বিষ হয় এখন ওদের।
          থামো তো তুমি। বিষ আজ ঝেড়ে দেব দুটোরই। ভাল আস্তানা করে নিয়েছে...
          আরে। এই দেখো। কথা বললে যদি শোনে এই মানুষটা।
          রামঠ্যাঙানি খেলে একদিন শায়েস্তা হয়ে যাবে ঠিক। দ্যাখ, দ্যাখ হারামজাদারা...
          বেসিনের লাগোয়া জানলা ইন্দ্রদের ড্রয়িংরুমে। বাইরের একখণ্ড জমিতে বাবার হাতে করা অল্প ফুলের বাগান। পাঁচিলের ওপাশে তীর্থদাদের খিড়কি। বাড়ির লোকজনের খুব বেশি চলাচল নেই সেদিকে। তিনতলার ছাদ থেকে কতদিন পাড়ার কুকুরগুলোকে নিশ্চিন্তে তীর্থদাদের খিড়কির ছায়ায় শুয়ে থাকতে দেখেছে ইন্দ্র। আজ সকালে কোনও কারণে হয়তো খোলা হয়েছিল খিড়কির দরজাটা।
          নরম একটা কিছুর গায়ে সপাটে লাঠি চালানোর মতো আওয়াজ হল। পরমুহূর্তেই ক্যাঁক করে একটা সারমেয় আর্তনাদ। তারপরেই পাঁচিল টপকে দুদ্দাড়িয়ে ইন্দ্রদের বাগানে নেমে এল পর পর দুটো কুকুর। একটার বেশ ধাড়ি চেহারা। অন্যটা মাদি। পাঁচিলের এপাশে নেমে আবার নিজেদের কাজে লেগে পড়ার তালে ছিল কিনা কে জানে। জানলার পাশে ইন্দ্রকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাগান পেরিয়ে আবার দুটোয় ছুট লাগাল সদরের দিকে। লালরঙা মাদিটাকে চেনে ইন্দ্র। অনেকদিন থেকেই রয়েছে পাড়ায়।
          পাশের বাড়ি থেকে পরিচিত পুরুষ কণ্ঠের গজগজানি শোনা যাচ্ছিল তখনও, রাসলীলা ফেঁদে বসেছে একেবারে... শালারা...
          ধড়াম করে তীর্থদাদের খিড়কির দোরটা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ শোনা গেল।
          দিব্য আর অজয় এসে গিয়েছিল। ঘণ্টা দুই-আড়াই বাইরের ঘরে এখন এই দু’জনকে নিয়ে কাটবে ইন্দ্রর। তারপর আবার অখণ্ড অবসর। গোড়ায় যদিও ব্যাচ শুরু করেছিল জনাপাঁচেককে নিয়ে। আসলে স্কুলের টিচারদের কাছেই হত্যে না দিলে যে পরীক্ষার খাতায় তেমন হেরফের হবে না—বোঝা হয়ে গেছে সবারই ইদানীং।
          অনেক চেষ্টাতেও আজ মাধ্যমিকের টেস্ট পেপারে মন বসছিল না ইন্দ্রর। দিব্যদের না-পারা প্রবলেমগুলোকে যেন থেকে থেকে দুর্বোধ্য ঠেকছিল তার নিজের কাছেও। সকালের ওইটুকু ঘটনাই যেন আচম্বিতে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে তার মানসিক স্থিতির শিকড়টাকে।
          একটা সিজনও মিস করাই না রে আমি ইন্দ্র, কালচে মেরে যাওয়া দাঁত বের করে বেজায় হাসতে হাসতে বলছিল বাপ্পা, বরানগরে বিচ আছে একজনের। কুকুরের ব্যাপারে আমার এনসাইক্লোপিডিয়া উৎপলদা...
          থাম। আর নিতে পারছি না জাস্ট। বছর বছর লাগিয়ে আনাতে হবে কুকুরকে!
          নয় তো কী! এ কি আতিপাতি কেস রে ভাই? অ্যাফোর্ড করতে না পারলে কে তোমায় কুকুর পোষার দিব্যি দিয়েছে বাপু...
          বলতে চাইছিস নিজে খাই না খাই কুকুরের খোরাকি মেটাতে হবে?
          একজ্যাক্টলি। নিজে লাগাই না লাগাই কুকুরকে লাগিয়ে আনাতে হবে। উৎপলদা তাই বলে, একটা সিজনও মিস করাবে না বাপ্পা। মহাপাপ হবে। সব জানোয়ারকেই একটা স্পেসিফিক লাইফ সাইকেল দিয়েছেন ভগবান। তুমি কে হে খোদার ওপর খোদকারি চালানোর?
          বরানগরে নিয়ে যেতে হয় তাই বলে?
          একটা পেডিগ্রি আছে না আমার অ্যালসেশিয়ানের! পাড়ার নেড়িগুলোর সঙ্গে তো আর ছেড়ে দিতে পারি না। তুই একটা ইঞ্জিনিয়ার ছেলে। করবি বাড়ির ঝিয়ের মেয়েটাকে বিয়ে?
          সেম জাতের বিচের খোঁজ পাব কোথায়?
          ডগ শো থেকে পাওয়া যায় লিঙ্কগুলো...
          মনে মনে ভাবছে তখন ইন্দ্র। মানুষের বদলে কুকুর হয়ে জন্মালেই শালা ভাল হত।
          কিন্তু ঠিক মাস ছয়েকের মাথায় যেদিন নিজের চেম্বারে ডেকে কথায় কথায় ‘সন অফ বিচ’ বলেছিল ভৌমিক, সপাটে একখানা চড় কষিয়ে দিয়েছিল ইন্দ্র। অফিসের ভেতরে তো বটেই, এমনিতেও সবাই বেশ সমীহই করে চলত ভৌমিককে। মজবুত হাতের এক থাবড়ায় চেয়ার ধরে নেওয়া লোকটার ভয়ার্ত চোখের দিকে তাকিয়ে সেদিন অবাকই লাগছিল ইন্দ্রর। অবাক হয়েছিল বাকিরাও।
          কিন্তু এরপর যা হয় সচরাচর, নড়চড় হয়নি তার কোনওটারই। ডিসিপ্লিনারি প্রোসিডিং-এ চেম্বারের ভেতরের ঘটনাটারও অতজন সাক্ষী জুটে যাওয়া হয়তো কিছুই আশ্চর্য নয় আজকের দিনে। বেরিয়ে আসার মুহূর্তে অত সন্ধের স্কচের পার্টনার পবিত্রদা থেকে অত সফট কর্নার তৈরি হওয়া নম্রতা অবধি অতজন সাক্ষীর সকলেরই মাথা নামিয়ে নেওয়াও হয়তো স্বাভাবিকই আজকের দিনে। বুট গটগটিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে খালি মনে হচ্ছিল সেদিন—ভালই হল এতগুলো কুকুরের ভিড় থেকে সরে এসে।
          কিন্তু এই কুকুরদের পোষে যারা, সচরাচর চোখ আর কানদুটো তাদের ছড়ানো থাকে অনেক দূর অবধি। ইছাপুরের কোন পাড়ায় কী জাতের ডগ আছে আর বরানগরের কোন গলিতে সেই প্রজাতির বিচ পাওয়া যাবে তার সুলুকসন্ধানগুলো থাকে তাদের নখদর্পণে। ভৌমিককে চড় মারার পর দেড় বছরের বেশি হয়ে গেল তাই—হপ্তার প্রত্যেকটা দিনই ইন্দ্রর রবিবার।

আমিও তো একটা জানোয়ার। মানুষ নিজেই তো এভোল্যুশনের পথে আসা একটা দু’পেয়ে জানোয়ার। আর তাহলে একটা স্পেসিফিক লাইফ সাইকেল আমাকেও তো বরাদ্দ করার কথা তোমার ওই ভগবানের। সিজন যে থেমে নেই আমারও। আচ্ছা, নয় ধরে নিচ্ছি তুমি পরম নাস্তিক। কিন্তু তাহলেও ওই স্পেসিফিক লাইফ সাইকেলটা আমাকে দিয়েছে স্বয়ং নেচারই। মাঝখানে কে হে তুমি মহাপুরুষ খোদার উপর খোদকারি মারানোর?
          কম দামের হুইস্কিতে নেশাটা ধরে যায় ক্যাঁক করে। কিন্তু অনেকদিনের অভ্যেস একেবারে ছাড়তে পারেনি ইন্দ্র। স্কচ খাওয়ারও সঙ্গতি নেই ইদানীং। মাসে একদিন অল্প পয়সায় বিলিতি ধুনকি নিতে চাইলে এই ছাইপাঁশগুলোই আজ সম্বল। ওদিকে যে হারে জলের দাম চড়ছে দিনকে দিন। তাও তো সিগারেটের নেশাটা নেই ল্যাওড়া।
          শ্রীধর বংশীধর রোডে ঢুকতে ঢুকতে আকাশপাতাল ভাবছিল ইন্দ্র।
          আজকের দিনে ভাল করে খেয়েপরে বেঁচে থাকতে চাইলে শালার কুকুর না হয়ে গতি নেই। আর ওঁচাস্য ওঁচা কপাল করে আসে বোধহয় মানুষের মধ্যেও এই পুরুষের জাতটা। পকেটে যদি তোমার না থাকে রেস্ত, হতে হবে সেই শালার কুত্তাই।
          কুত্তাই যদি হতে হয়...
          হাঁটতে হাঁটতে অবিন্যস্ত পায়ে অনেকটা চলে এসেছে তখন ইন্দ্র। স্ট্রিটলাইটের পোলের দাগে ঠিকানা এখানের বাড়িগুলোর। জ্যান্ত হোক কানা হোক—পোলগুলো এই চত্বরের মূর্তিমান মাইলস্টোনের মতো। এমনই একটা পোলের কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। সকালবেলার সেই মাদিটাই না? শুয়ে আছে আড় হয়ে গলির মুখে। মলিন আলোয় চকচক করছে পুরন্ত লোমশ পাছাখানা। নেশাতুর ইন্দ্রর চোখে ঝিলিক দিয়ে ওঠে প্রথম রিপু।


                                                                          (চিত্রঋণ : George Rodrigue)

1 comment: