আঞ্জিনার চাবুক
আঞ্জিনা,
শীর্ণ মানুষ, বাদামি চক্ষু, তবু তার উপস্থিতি যেন অস্থির শরতের বাতাসে ছাতিমের
কুর্ণিশ পায়। গ্রন্থের ভার আঞ্জিনাকে ন্যুব্জ করতে পারেনি। সে সুঠাম, সুস্থির,
তিমিরের কোলে মাথা দিয়ে থাকে। আঞ্জিনার হাতে কোন রেখা নেই, বুধ নেই, শনি নেই –
কেবল শুক্রের কাটাকুটি জ্বলজ্বল করে। তার ইদানীং আত্মকথা লিখবার জন্য একটা চাবুকের
দরকার ছিল, কিন্তু সে গুড়-বাতাসা দিয়ে মুড়ি খাওয়া শুরু করেছে। শুকনো মুড়িগুলি,
আঞ্জিনার গাল থেকে উড়ে গিয়ে তক্তপোষের ধারে চলে যায়। মাথায় ঘুরন্ত পাখা। কাকের
ডাকে, জল হাওয়া পূর্ণ হয়ে আছে। কাঁসাই নদীর ধারে ঘুরতে ঘুরতে সে বার কয়েক একটা
ড্যাম্প দেখে এসেছে। জল উগরে দেওয়া
ড্যাম্প। যে দেশের মাটি রোদ্দুরের চাবুকে মার দেওয়া কাপড়ের মত খড়খড়ে হয়ে থাকে,
জোছনায় বাদুড়ের মত মেজাজে – ঝুলে থাকে নদীর পার ধরে ; সেই দেশের মেয়ে সে, নিজের
আত্মকথা লিখতে বসে সে একটা চাবুক রাখবেনা কাছে!
দিন যায় মরশুমি জলা বাতাসের দিন হু হু করে
পেরিয়ে যায়। আঞ্জিনার দেহ যেন এবছর আরও কর্কশ, আবলুশ আরও। ছাতের ছোট্ট ঘরে বোঝাই
করা বই তার। নিচে মাটি আঞ্জিনাকে বইগুলো সঙ্গে করে ডাকে। জানলার চৌকাঠে মাথা রেখে
সে রিকশার যাতায়াত দেখে। আত্মকথা কি দুর্ভেদ্য মানবজীবনে। সে ভাবে, কোন মানুষ
আত্মকথা কিছুতেই লিখতে পারেনা। সে জানলার দিকে মুখটা তেরছা করে একটা জুতো সেলাইয়ের
লোককে দেখে, লোকটার বয়স আটচল্লিশ না
আটচল্লিশ বছর সাত মাস – সে মাপে, তারপর তারপর লোকটার পায়ের দিকে তাকায়, জুতো নেই,
সামনে অনেক জুতো রাখা – কিন্তু এর মধ্যে কোনটা সেই জুতো-ওয়ালার জুতো, খুব নিপুণভাবে
জানলার গরাদগুলোতে চোখ রাখলে – আঞ্জিনা দেখতে পায় জুতোওয়ালার আঙুল। একটা ব্যাগের ভিতর চলে যায় আবার ফিরে আসে। ব্যাগের
চারিধার ধরে সুতোর বুনট জমতে থাকে। এত সূক্ষ্ম, বেজোড় একটা মুদ্রা হাতটির – কানের তরুণাস্থি
দিয়ে, লতির কাছে নেমে এলে এই মুদ্রা মানুষকে শিহরণে পাগল করে দিতে পারে। মানুষকে
পাগল করে – জুতো-ওয়ালার কি লাভ? আঞ্জিনার একটা বিরাট পেয়ারা গাছের কথা মনে পড়ে। মনতোষ
পিছনে আঞ্জিনার পায়ের জায়গায় পা রেখে রেখে উঠছে, আর আঞ্জিনা উঠছে আগে আগে, মাটির
থেকে একটু একটু করে উঁচুতে উঠে, সবার নাগালের উঁচুতে – উঠে প্রথম পেয়ারাটা হাতে
নিয়ে সে ছুঁড়ে দেয় নিচের দিকে, মনতোষ ধরতে পারে না, আঞ্জিনার মাথায় খুন চাপে, সে ঝাঁপিয়ে
নামে মনতোষের থাইয়ের উপর, দুজন মিলে ডালটা ভেঙে মাটিতে পড়তে যাবে কি – আঞ্জিনার জামাটা একটা ডালের খোঁচে আটকায় – একটু সময়
পেতেই সে ডালটা ধরে নিজেকে বাঁচিয়ে নেয়, কিন্তু নিচে পাথরের উপর মনতোষ তখন ছটফট
করছে রক্তে, মাথা ভেসে যাচ্ছে। রাগটা আঞ্জিনার তখনও যায়নি, যে ঝাঁপ দেয়, দিয়েই আগে
কষিয়ে একটা থাপ্পড় চালায় তারপর মনতোষের মাথায় থোক করা গাঁদার পাতা দিতে গিয়ে
থমকায়। সেই ছবিটা তার তিনতলার এই ঘর থেকে প্রায়শই চোখে আসে – যখন সে জুতো ওয়ালাকে
দেখে। মাথার ঐ চিরে যাওয়া ক্ষত স্থানটা কি নির্লিপ্ত ভাবে সেলাই করেছিল শক্তি
নার্স।
শক্তি
নার্সের হাতের কব্জির জোর দেখে আঞ্জিনার তাক লেগে গিয়েছে বহুবার। শাড়িটাকে হাঁটু
অবধি তুলে দুটো পায়ের মাঝখানে নারকেল রেখে, একটার পর একটা মাখনের মত ছাড়িয়ে নিতে
পারতেন উনি। নারকেলের মাথাটা এমন করে ধরতেন যেন, নতুন কোন শিশুর পা ধরে তাকে
চ্যাংদোলা করেছেন। এই ছবিতে যেন নারকেলের গায়েও কিঞ্চিত লেপটে থাকা রক্ত। এই শক্তি
নার্স যদি আত্মকথা লিখতেন। অমন জাঁদরেল, দাপুটে দেহের আত্মকথা, কি করে লিখতেন উনি?
এর উত্তরে, আঞ্জিনার কেবল ঐ রক্তাক্ত নারকেলের কথাই মনে পড়ে। অতিকায় মানুষের আত্মকথা
লিখতেও তো চাবুক লাগবে। দেহটাকে বশে না আনলে, কেমন করে এই হাজার একশ কাণ্ড কারখানাকে
সায়েস্তা করে কেবল নিজের কথাটুকু তুলে আনা যাবে?
এই যে তার হাতে রেখা নেই, আঞ্জিনা ভাবে। দেহে
রস নেই, মাথার চুলের পাটে সৌষ্ঠব নেই। ঘরের দেওয়ালে জৌলুশ নেই। মাটিতে শীতলতা নেই।
চৌকাঠে, কাঠের লেশ আছে মাত্র। আলনার দুপায়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। এই ঘরখানায় যখন,
ধোপা আসে, শন্তু ধোপা তখন কি সে এতটাই কেজো যে, ধোপাকে এককাপ চা করেও খাওয়াতে
পারেনা। বলতে কি সে পারে না, “এই বইগুলো একটু ধরে দেবেন, বেলা হয়ে এলো, এগুলো আমার
এখনো মুখস্থ হলনা”। কত সহস্র বছর হল, আর সে কিছুই
মনে রাখতে পারেনা। ঘরের কথা মনে এলে, মহাতাপ হোসেনের বানানো ঘরটাই মনে পড়ে, ঝুলনের
দিনে বাগানের একটা পাশে আঞ্জিনার জন্য একটা ঘর মহাতাপ বানিয়ে দিয়েছিল। আঞ্জিনাকে
সে ভালবেসেছিল কতদিন, তার চেয়ে কত দিন হল, তার হাত সুড়সুড় করে, বেমক্কা মহাতাপের
পীঠে এলোপাথাড়ি চড়চাপাটি চালাত সে, মহাতাপ ঘুরে তার চুলের মুঠি ধরেছিল। লাথি মেরে
ভেঙ্গে দিয়েছে সে ঘর। একটা চাবুক থাকলে সে ঘরের কথাও তো আঞ্জিনা লিখতে পারত।
বহুদিন
হল, কালো কফি খেয়ে খেয়ে তার জিভটা ভিতরের দিকে টানে। খাবার গলা অবধি এসে আর নিচে
নামতে চায়না। কিন্তু মন টানে পশ্চিমের ঐ জানলাটার গরাদ জড়িয়ে থাকতে – জুতো ওয়ালার
পাশেই আছে সোনার দোকান, সোনা মুদি – সোনা মুদিকে – আঞ্জিনার এখনো আকাশের দিকে
তাকিয়ে বলতে সাধ হয় – চাঁদের মত দেখতে ছিল। সোনার নতুন বউ, আঞ্জিনার এই ঘরটায় এসে
বসত শীতের দুপুরে, তার খাতার নম্বর গুনে দিত, কখনো কখনো তার জন্য ভাত বেড়ে দিত।
কিন্তু সোনা চলে যাওয়ার পর তার বউ আর আসেনা এই ঘরে। সোনার গল্পটা যদি একটা চাবুক
না পায় তাহলে আঞ্জিনা কিছুতেই যে লিখতে পারবেনা। গভীর শীতের সন্ধ্যা বেলা, সবে গুরু-দুয়ারের
প্রসাদ খেয়ে ঠাণ্ডা ভিজা স্নান করা গায়ে, সোনা জলের পাম্পটা লাগাতে গেছে। এই পুরো
রাস্তা জুড়ে কুকুরে কুকুরে ছয়লাপ। সোনার দেহের চারপাশে বসে পড়ে দাঁড়িয়ে, শুয়ে তারা
কাঁদছিল। এক গোটা শ্মশান ভর সন্ধ্যে বেলা পাড়ার মধ্যে খানে জেগে উঠেছিল।
ডাক্তার এক বন্ধু, অনেক দিন ধরে আঞ্জিনাকে
ওষুধ নেওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। আঞ্জিনার দেহে জল কমে আসছে। চোখে কিছুতেই জল আসেনা। চোখ শুকিয়ে থাকে সবসময়।
শ্মশানের কথা মনে হতেই, একের পর এক ছোটা হাতিগুলোর কথা মনে পড়ে তার – একজীবনে এত
কিছু মনে পড়তে, পড়তে যেন কোন একদিন মুখের ভিতর থেকে অনেক সাপ লক লক করে বেরিয়ে
আসবে, এটাও তার মনে হয় যখন সে জানলার গরাদ থেকে মাটির দিকে চায়, মাটি ডাক পাঠায়।
এখান থেকেই আঞ্জিনা দেখেছে, কলাবউ আনবার জন্য কত ছোটা হাতি, শ্মশান যাত্রীদের মত
পাল পাল মহিলাদের তুলে নিয়ে, ছুটে যায়। একটা খাঁচায় ভরে যেন অনেক জন্তুদের
জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। কর্কশ চামচিকার মত সধবারা হাসতে থাকে, বল হরি হরি বোল বাজে
আঞ্জিনার মাথার ভিতর। কাকের ডাক থেমে গেল কেন। ঘেয়ো কুকুরগুলোকে লেলিয়ে দিতে চায় সে এর ওর দিকে। এই সময়টা আর তার শরীরে শরীর থাকেনা। সুখী সতীগুলোকে দেখে তার আঁশবটি দিয়ে কাটতে ইচ্ছে করে। এদের কথাও সে চাবুক ছাড়া লিখতে
পারবেনা। তক্ত পোষে চাপড় দিয়ে, সে একটা গোটা খাতা বুনো ভঙ্গীতে ছিঁড়ে দেয়। তারপর
হাতে কামড় দিয়ে জানলার ধারে বসে আবার।
ইশকুলের ছুটির মরশুম চলছে এই মাহিনায়। খুচরো,
চা বৈঠকি বিপ্লবের লেখা তার শরীরে পচ ধরায় আজকাল। একটা আসুরিক কাব্য লিখতে হবে, যে
করেই হোক। বেলা বয়ে যায়, তার একটা চাবুক প্রয়োজন। দাগ রেখে যাওয়ার মতন চাবুক।
কিছুতেই যে চাবুকের ডর নেই, কিছুতেই যার কাম নেই। কামের কথা জানত কেবল একজন সে
সূত্রধর। তার বাড়ির গ্যারেজ ঘরে ইশকুলের ছেলে মেয়েরা পালিয়ে গিয়ে মিলিত হয়; এই খবর
কানে আসতেই আঞ্জিনা, ইশকুলের দুটো মেয়েকে পাকড়াও করে, মূলত সূত্রধর বলে একটি ছেলে,
হাড় হারামজাদা, সেই এই সব কাজকর্ম শুরু করেছিল, হেড মিস্ট্রেস জানায় - আঞ্জিনাকে। আঞ্জিনা কোনো পুরুষ শিক্ষকের তোয়াক্কা না করে, ইশকুলের স্টেজের উপর তুলে
সূত্রধরকে বেধড়ক মারতে থাকে। আঞ্জিনার এই চন্ডিমূর্তি সাধারণ সময় কারোর নজরে
পড়েনা। কিন্তু একটা দমধরা বাতাস যেন, তার মধ্যে আটকে থাকে। একটা খুনে কুকুর যেমন
ঝিমিয়ে শুয়ে থাকে সিঁড়ির নিচে, আলো আধারিতে, তেমনি স্যাতলা একটা চার দেওয়ালির ভিতর
আঞ্জিনা অস্ফুটে ফোঁস ফোঁস করতে থাকে দিনভর, রাতভর। শুধু লেখবার একটা বাড়তি হাত
আছে বলে, এখানকার সংস্কৃতিচর্চার লোকেরা আঞ্জিনাকে খুব সম্মান করে, নানা বিষয়ে
সাহায্য করে। তার বয়স কেউ মেপে বলে দিতে পারবেনা। সংগ্রামী মানুষের বয়স একটা বয়সের পর থেকে থমকে যায়। একেবারে মৃত্যুর আগ দিয়ে
সে দেহে হয়ত খানিক আমূল পরিবর্তন আসে বলে আঞ্জিনার মনে হত মাঝে মাঝে। তার এই
একরোখা জীবনটায়, কিছু যদি সে না লিখতে পেরেছে তবে সে তার একটা চাবুক নেই বলে। একটা
তেল চকচকে চাবুক।
এর কথা সে, কাকেই বা বলত? যেদিন সকালে
সূত্রধরকে সে পেটায়, সেদিন দুপুরে গিয়ে সে হেড মাষ্টারের কাছে একটা চাবুক আনাবার
কথা পেড়েছিল। হেড মাষ্টার হেসে বলেন,
-“কি
শঙ্কর মাছের চাবুক? এটা সার্কাস নয় মাদাম, এটা তো ইশকুল, আপনার ছেলে-মেয়ে, মানে
ভাই বোনের মত এরা সবাই – এদের আপনি চাবুক দিয়ে পেটাবেন?”
-
আঞ্জিনা উত্তর করে, “চাবুক কি শুধু পেটাবার জন্য নাকি?”, আর “আপনার বাবা আপনাকে
কোন দিন বেল্ট দিয়ে পেটায় নি ?”, “চাবুক তো একটা প্রতীক স্যার। যেটা দেখলে শয়তানেও
ডরায়”।
- হেডমাষ্টার
বিচলিত হয়ে বলেন, “আপনি ইদানীং ভীষণ অসংলগ্ন কথা বলছেন – আপনি ছুটি নিতে পারেন, ইদানীং
মেয়েদের একটা ছুটির ব্যবস্থা...”
হেড মাষ্টার মাথা তুলতেই, আঞ্জিনা হাঁটা দেয়।
তার পায়ের শব্দে যেন ঘরটা কেঁপে ওঠে। সেদিন বাড়ি ফেরার সময় আঞ্জিনা, একটা
স্পোর্টসের দোকানে ঢুকে, শর্টপার্টের লোহার বল গুলো নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখছিল – হঠাত
সে দোকানদারের দিকে চেয়ে দেখে, কেমন সন্দেহ হয় তার – মনে হয় দোকানদার লোকটা যদি
কোনদিন আত্মকথা লেখেন, তাহলে কি তিনি এই লোহার বলগুলো লিখবেন। ঐ যে ব্যায়ামের বইটা
তাকে রাখা, ওটার উপরে ছাপা নারীদেহটা কি এই
দোকানদারের পছন্দ? দোকানদারের হাতটা এমন খাটো কেন? ইনি কি ছেলেবেলা থেকে খুব ভারি
জিনিস তুলতেন? চকিতেই আঞ্জিনার কুয়োর বালতির কথা মনে আসে – কুয়ো ঝালাই করা একটা
মানুষের কাঁধে চেপে আঞ্জিনা একদম নিচ অবধি গিয়ে ছিল। চাবুকের দাপটে ছিন্ন ভিন্ন
হয়ে যাওয়া দেহ যেমন কাতরাতে পারে, কুয়োর নিচে ঐ গরমে ভ্যাপসায়, রোগা, কুঁজো এই
লোকটাকে দেখে আঞ্জিনার তেমন বুক কাতরাচ্ছিল।
আঞ্জিনা বুকে হাত দিল, কাঁসাইয়ের ড্যাম্প থেকে
অনেকগুলো চাবুক যেন আছড়ে পড়ছে, জলরাশি। অথচ খাঁ খাঁ করছে চারিধার যেন। বাইসাইকেল
করে যে বড়মানুষের ছেলেগুলো ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে যেত, আঞ্জিনা তাদের বার কয়েক ঢিল
ছুঁড়েছে। হাতে ধরে মানুষ পেটানোর মত একটা রাগ ঠিক ঢিল ছুঁড়ে যায়না। ঢিল জিনিসটা
খুব চৌক মতন, লম্বা লকলকে সপসপে একটা প্রাণীর মত দাপুটে সে নয়। এমন প্রাণী সে নয়
যে ক্লান্ত হয়না। ঢিল কিছুক্ষণ পরেই ক্লান্ত হয়ে যায়।
সূত্রধরের বাড়ির লোকেরা, খানিকক্ষণ আগেই তাকে শাসিয়ে
গেছে – “শালা, আপনাদের মতন, খানকি লেখিকাদের আমার জানা আছে – বছর পঞ্চাশের এক
অফিসার গোছের বাবু তেতলার ঘরে বুট পরে এসে এমন ঝাঁঝে কথা বলছে, আঞ্জিনা চকিতে রঙ
বদলে নিতে পারত – এরকম নধের চাঁদগুলোকে গোড়ালির তলায় এনে পিষে দিতে মাত্র কয়ের
সেকেন্ড সময় লাগতো তার হয়ত। সূত্রধর, তার বাপ হলধর কি ন’ধর যাই হোক – আঞ্জিনা ভাবে
এদের জন্য একটা চাবুক লাগবে তার – নইলে সে আত্মকথা লিখবে কি করে?
কিন্তু সন্ধ্যার চাঁদ এসে জানান দেয়, এ বড় বেমানান
জোড় ভেবেছে সে। লেখা চাবুক দিয়ে হয়না। নির্বিষ ঠাণ্ডা কলমটা দিয়েই তাকে লিখতে হবে।
আঞ্জিনা যা করণীয় তাই করেছে, তবুও রাত্রির জোর বিপুল, রাত্রি তাকে বিমূঢ় করে তোলে।
চোরা আলোয়-অন্ধকারে বিস্তীর্ণ ফন্দী আঁটে।
এরপরে ইশকুল কর্তৃপক্ষ আর আঞ্জিনকে ইশকুলের ত্রিসীমানায়
ঢুকতে দেয়নি। সূত্রধরের ঘরের বউ-ঝিরা আঞ্জিনকে নিয়ে হেসে লুটোপুটি যায়। আঞ্জিনের তারুণ্যের
গান, এই পাড়ায় আস্তে আস্তে কালো মশকরার মতন সংক্রামক হয়ে উঠেছে, আর কিছুদিনের
মধ্যেই আঞ্জিনের মধ্যেকার মানুষটি গাছের মগডাল থেকে উড়ে যাবে । তার আগে আপাতত সে পথের এক প্রান্তে শায়িতা । তার জীবনের অগণন নাজানা কথা সে আউড়ে চলেছে মাঝে মাঝে রঙিন
চকে রাস্তায় আঁক কষছে। আর তার চাবুকের মতন উলঙ্গ দেহটা কুঁকড়ে পড়ে আছে মাটির উপর। সে কুঁকড়ে শুয়েছে, তার ভয় – তিন তলার ঐ
ঘরটা যেকোনো সময় তার উপরেই শুধু হুড়মুড়িয়ে পড়বে। ঘর ধুপকরে তার উপর ধসে পড়ল।
সকালের আজান, আকাশ বেগুনি হয়ে এসেছে। সে ধড়ফড়
করে উঠলো। তার বুক-দুটো গরম একটু মাংসল যেন, দৃঢ় হয়ে ফুলে আছে। সে গায়ের চাদরটুকু
আরেকটু আদরে জড়িয়ে নিলো বুকে। সামনে যেন কোন শান্ত সুন্দরী নগ্ন চিত্রের মত গোলাপি
আলোর মাঝে, চন্দন কাঠের উপর শুয়ে আছে। সেই কাঠের গায়ে খানিকটা দাগও যেন। ঘরময়
মৃতের ধূপের গন্ধ। ঘরময় একটা শান্ত দেহের নিস্তব্ধতা – এই আবার তার ঘুমভাঙ্গলো।
ঘুম ভেঙ্গে সে প্রকাণ্ড এক অনিশ্চয়তার কোপে পড়ল। আঞ্জিনার নতুন গল্প শুরু হল।
আঞ্জিনার খিদে পাচ্ছে, আঞ্জিনার মাসের খরচে মাস
চলে – মাসের খরচে অল্প একটু মদের খরচও যুক্ত-ছিল। গত চারদিনে সে খরচ পলকে বেহিসেব। ভোরের কোথাও গান বাজে – কোথাও নিশ্চয় বাজে,
আঞ্জিনার মাথা, বাতাসের ভারে নিস্তেজ হয়ে এলো, বাতাসের কল্লোলে বাদলে মর্মরে, তার
কাজল গালে লেপটে গেল। এত ভার তার? মদের মুক্তি সরতাজের মত নিয়েও তাকে এমন ঝুঁকে
হাঁটতে হচ্ছে? সে ভাবল আবার তার পথ তাকে ঠকিয়ে স্বপ্নের ভিতর চলে যাচ্ছে। পা টা
জোরে ঠোকা দিল মেঝের উপর। শরীর ছিঁড়ে গেল যেন, সম্বিত এলো।
তার গল্পগুলো মেঝের উপর লুটিয়ে আছে যেন, কে
তাদের হাতে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে দেবে? ওখানে কাওচের চাচা আছেন দুহাতে শেকল পড়ে,
গরাদের পিছনে। জেলখানার যেকোনো বড় বাড়ি গরাদ দিয়ে ঘেরা। চাচী বাজারের থলির ভিতর
খাবার নিয়ে রবিবার চাচার সাথে দেখা করতে
যান, দ্বারকা নদীর বহু চর শুকিয়ে ধানী জমি হয়ে গেল – এখনও চাচীর হাত লোহার
মত শক্ত। চাচীর ঘরে রাখা কুঁজো গুলো থেকে থেকে আঞ্জিনার হাত স্পর্শ করে যেন – ধুলো
পথের উপর ঠাণ্ডা জল ঢালতে থাকলে, বালি থেকে কাদা হয়ে, মাটির সোঁদা গন্ধ মাথার ভিতর
ঘুরে ঘুরে। কি একটা গান, আঞ্জিনার মধ্যে
একটা ঝড় দিয়ে চলে গেছে – জেলের খাঁচা ঘরে বসে, চাচার সেই গান, গুম গুম গুম গুম করে
এখনও কানের ভিতর। আঞ্জিনা জানলা দিয়ে
তাকাতেই, ডমরু হাতে মানে ডুগডুগি হাতে কাগজ ওয়ালা হেঁকে যাচ্ছে – গানের কথা
আঞ্জিনার মনে থাকেনা, গান বাজতে লাগলে, আরও খানিকটা বাজতে থাকলে, কথা আসতে থাকলে,
কথাগুলো পর পর আসতে থাকলে - সাথে সাথে মনে
পড়তে থাকে, তাই তার গলায় সুর নেই, তেমন তেমন-ই তো মনে হয় যখন মনে হয়, সে গাইবে,
ঘরের এপ্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ছুটে ছুটে যাবে আর গাইবে। তারপর থামে, তার দিগন্তব্যাপী
জংলা গাছের বনের কথা মনে পড়ে, যে গাছের পাগুলো সব ঢাকা, সব, হাতে আঁকলে কাটাকুটি
আঁকা যায়, প্যাঁচ দিয়ে গোল করে করে আকৃতি গুলো, তবে তাদের অন্ধকারে আঁকা খুব মুশকিল,
সব একজোটে কালো হয়ে থাকে, গাছেদের পায়ে পায়ে আটকে গ্যাছে।
জঙ্গলের ভিতর গাড়ি থামলে মানুষেরা হাতি দের
দূর থেকে দেখে, পাখিদের গা দিয়ে ক্যামেরার আলো ছুঁড়ে দেয় – শিথিল হয়ে যাওয়া
বৃষ্টির ফোঁটায় বাঘের পায়ের ছাপ – বাঘের গল্পও তো তার একটা থাকার কথা, বাক্স প্যাঁটরার
ভিতর, যেখানে – বাঘ বাক্স প্যাটরার ভিতর ভেবে এবারে – এত কিছু জটের মধ্যেও, তার
জটা পড়া চুল থেকে যেন একটা হাসি সকাল বেলা নেমে এলো। হাতে ঝাঁটা নিয়ে সে ঘর পরিষ্কার করতে নামল, জেরক্সের প্লাস্টিকগুলোর ভিতর,
যেখানে সব হলুদ হয়ে যাওয়া লেখাগুলো জমা। তাদের বন্দী করে রেখে কষ্ট দেবে সে কতদিন।
জানলা দিয়ে ফেলে দিলে, তার সাথে তাকেও যে চলে যেতে হয় – তার মত অকালকুষ্মাণ্ড
একটা, সে কি কোনদিন গল্পগুলোর সাথে পথে নেমে যেতে পারে? রাস্তায় একেবারে – দুয়ারে
দুয়ারে গিয়ে যাচাই করতে পারে, কেমন ছিল তার গল্পগুলো। এই ভাবনাটা আশ্চর্য গতিতে
তার মধ্যে প্রবেশ করল এবং অদ্ভুত শান্তভাবে দাঁড়িয়ে পড়ল – সে নয়, তার এই ভাবনাটা।
সে তো বসেই ছিল, ওলট পালট করছিল মাথাটা নিয়ে, বন্ধ একটা ঘর – কেউ আসেনা, কেউ
যায়না, এ ঘরের জানলার কপাট খোলা, তবু কোন দিক দিয়ে আঞ্জিনের ঘরে ঘরে নামা হয় নাই।
শুধুই ছাত দেখা যায়, কোনটা টালির, কোনটা পেটাই – জলছাদ। বাংলার কত মানুষ, দেশের কত
মানুষ, পৃথিবীর মানুষ – সবার কথাই তার বারে বারে মনে হয়েছে – নিজেকে ভালো করে
সাজানো হয় নাই; এই ঘরের বাতাস, কত দিন পশ্চিমের রোদ্দুরে তর্কা লাগিয়ে গেছে, তখনও
তো সে ঘুরে ঘুরে একা একা নাচতে পারত – গাইতে তো সে পারেনা, তার জন্য কেউ গান
গাইলে, এই ঘরটায় এনে তাকে সে বসাত – কিন্তু কে গাইবে তার জন্য গান? ঐ যে অত মানুষ,
কে তাকে এমন শাখায় শাখায় চেনে?
গল্পগুলি কেমন করে পথে নামতে পারে, সেকথা
আঞ্জিন হারায় নি তখনো – সে জুতোর লেশ বাঁধলে, গায়ে ওড়না নিলে, চোখে চশমা আঁটলে।
ঘরের তালাটা তার দিকে বিনিদ্র তাকিয়ে ছিল, তাকেও ঝুলিয়ে দিলে সে। পায়ে হেঁটে সিঁড়ি
দিয়ে নেমে ইস্টিশনে এলে, ট্রেনে চাপলেনা। রেললাইন পার করে – নতুন পল্লির দিকে
হাটতে লাগলে, সকাল থেকে পেটে দানা নেই, হাতের নখ গুলো কেমন নীলচে। নতুন পল্লির
রাস্তাঘাট মাটির, ঘরগুলোর সামনে সামনে গাছ, তার কাঁটায় জড়িয়ে জড়িয়ে থাকা ফুল গাছ, ঠুঁটো
রেডিও , বারান্দার রেলিং রাখা, পিছনেই হয়ত টালির ঘর, এবছর ভোটের সময় এই
রাস্তাটাতেই অমানুষিক লড়াই হয়েছে। এখন বাতাসের উপর ভর দিয়ে কেমন যেন ছায়ারা সব দোল
খাচ্ছে। যে কোন ঘরে ঢুকতে গেলে আঞ্জিনের ভয় করেনা। ঘরের পাথর, গাছ, দরজার কাঠ, সব
কেমন জীবন্ত – কথা বলে, সবথেকে বেশী স্বতন্ত্র থাকে জুতোর তাক। কোন বাড়ির জুতোর
তাকের কাছে এলেই আঞ্জিনের মনে হয়, এই বুঝি পৃথিবীর কিনার – ওপাশে সবাই কেমন
দলবেঁধে, একে অন্যের চোখে চোখ দিয়ে বেঁচে আছে, আর অন্যদিকে আরেক উঠান পেরিয়ে মাটির
রাস্তা, পিচ, কংক্রিটের রাস্তা, যেখানে আত্মীয়তাও জ্বালা ধরিয়ে যায়, চাবুকের আওয়াজ
বাড়িয়ে তোলে।
আঞ্জিন আর কিচ্ছু না ভেবে ঘর ঢোকে, দরজা ঠোকে
– একটা বাচ্চা মেয়ে বাড়ির পিছন দিক দেথে বেরিয়ে এসে বাঁদিক দিয়ে উঁকি দেয় – এক
শ্বাসে, “বাবা নেই, মা নেই, কাকু নেই, জেঠি নেই, চাচু নেই, ঠাগমা নেইইই-ইই” বলে
আবার ছুটে পালায়। পাশের ঘরে এক বুড়ী এই চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে দরজা খুলতেই আঞ্জিনকে
বেবাক অবস্থায় সামনের বাড়ির দরজার সামনে দেখে, বলে – “ সাবান, ক্রিম আছে বুঝি
ব্যাগে?”। আঞ্জিন এগিয়ে এসে জানলার সামনে দাঁড়ায়, বলে আপনার নাম কি? বুড়ী কটমট করে
চায়, বলে “নাম দিয়ে কি?” আঞ্জিন বলে, “ নাম সই করতে পারেন?”, বুড়ী বলে “এপাড়ায় আমি
একমাত্র ম্যাট্রিক পাশ, বাকিরা কেউউ কিচ্ছুটি জানেনা”। আঞ্জিনা তাড়াতাড়ি বলে
“আপনার সাথে একটা দরকার ছিল” বলেই তার মনে পড়ে তামালির কথা, খুব মারে দুদিন উঠতে
পারেনি, জ্বর ছিল – তারপর ঠিক এমন করেই সে একদিন ছাদ দিয়ে উঠে শ্বশুর বাড়ির পিছনের
দিকে বুড়ী খুড়শাশুড়ির ঘরে গিয়ে ঢুকেছিল, শাশুড়ি চোখে কম দেখে – বলেছিল “কে ও – বৌ
নাকি?”, তমালী বলেছি, “হেপ মাগী, কথা বললে গলা নামিয়ে দেব এই দেখ কাচি এনেছি, এই
দিয়েই দেব গলায় ঢুকিয়ে” – তার
পর গয়নাগাঁটি সে যা পেরেছিল হাতিয়ে ছিল
শ্বশুর ঘর থেকে, যাবার সময় শাশুড়ির মুখ তাক করে একটা বাল্ব ছুঁড়তেই, খাটের ডাণ্ডায়
লেগে ছিটকে গেছিল অ্যাসিড – আঞ্জিন ভাবে ঢুকবে, ওভাবেই যেন একটা কিছু হেস্তনেস্ত
হবে। বুড়ী এসে তালা খুলে দেয়, “আঞ্জিন বলে ভিতরে যাবনা ঠাকুমা, চাতালে বসি – একটা
গল্প আছে শুনিয়ে চলে যাব।” আঞ্জিন দেখতে পায় রাস্তাগুলো সব বাড়ির সামনে সামনে গিয়ে
থেমেছে, কারা এই পথে নেমে যুদ্ধ করে? মল্ল যুদ্ধ? কারা প্রাণ পায় যুদ্ধ করে? তারা
কি কেবল এই কারণেই পথে নামে যে তাদের বাঁচতে হবে? বাঁচাটুকু ভুলে না গিয়ে পথে
নামতে পারে তারা? মারবে বলে নামে? আঞ্জিনের এই তো মনে হয় সারাদিন, একটা বেঁচে
থাকার ঝড় খালি মাথায় হামলা করে, বলে খারাপ কিছুতো একটা করতে হবে।
ঠাকুমা কিছু একটা বলছেন, আঞ্জিন তাকায় উপরে – ততক্ষণে সে চাতালে বসে একটা খাতা
বের করেছে পড়বার জন্য, ঠাকুমা বলছেন, “গবর্মেন্ট থেকে এসেচ বুঝি? পয়সা দিতে
পারবনা, বিয়ে করনাই?” – এটা শুনেই আঞ্জিন প্রথমে ভাবল, তমালী যেমন বেঁধেছিল তার খুড়শাশুড়িকে,
বেঁধে কাঁচি দিয়ে ভয় দেখিয়েছিল, আঞ্জিনও কি তেমন করে লুটতে পারেনা? ভর দুপুরে
লোকের বাড়ির দরজা হাট করেছে, সেও বা ছিনতাইবাজের থেকে কম কি? বলতে বলতে মোটর বাইক
একটা গমগম করে উঠুনের ভিতর ঢুকল। চাবিটা
বন্ধ করে, মাঝ বয়েসি একটা লোক নামল, বলল “কি ব্যাপার মা, ভর দুপুরে বাইরে চল ভেতরে
চল, এই যে আপনি কে? আপনি উঠুন থেকে বেরিয়ে এদিকে আসুন – ঘরে ঢুকেছেন যে, মেয়েমানুষ ভেবে কি ছাড় পাবেন ভেবেছেন, চোরের
আবার মেয়েমানুষ।” আঞ্জিন সটান উঠে দাঁড়াল, “তোর বাপ চোর” বলে একটা লাথি মারল বাইকটাতে, ছিটকে পড়ল বাইকটা সঙ্গে লোকটাও – এই আঞ্জিনের
ডানপায়ের বুড়ো আঙুলটা নিমেষে লাল, নখটা উঠে গিয়ে – শান্ত পায়ে সে বেড়িয়ে যেতে
গিয়ে দেখল – লোকটা চিৎকার করে পাড়া কাঁপিয়ে দিচ্ছে। আঞ্জিন একবার ভাবল সে তুলে
লোকটাকে মাথায় জল দেয় সেবা করে, কিন্তু ততক্ষণে তার মাথায় নিরস একটা জীবন খেলা করা
শুরু করে দিয়েছে। দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতেই হঠাৎ সে একটা মহিলার মুখোমুখি হল – “কে
গো দিদিমণি না?” আঞ্জিন দিদিমণি কথাটা শুনে আরও চটে উঠল মহিলাকে ঠেলে দূরে ফেলে
দৌড়াতে লাগল। সামনে রেলের লাইন, ট্রেনের শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল, সে তার প্রচণ্ড
সক্ষমতা দিয়ে ছুটতে লাগল, এত ছুট যে তার লুকানো ছিল সেকথা তার ঘরের কোন আসবাব জানত
না শুধু আঞ্জিন জানত কারণ তার একটা গোটা জীবন, বেমক্কা সে একঝলকে দেখল মাথার ভিতর
– সামনে গিয়ে একটা ডাইভ দিলেই সে ছবিটা বাঁধাই হয়ে যাবে। কোন একটা লুঙ্গি পড়া রিকশাওয়ালা,
তাকে বাঁচাবার জন্য পিছনে ছুটেছে, সে বুঝে ওঠার সাথে সাথে তার রিকশাওয়ালাকে ঘুরে
একটা চড় মারতে ইচ্ছা হল, কিন্তু সে দাঁড়ালনা, কেন সে দাঁড়ালনা ভাবতেই তার মনে হল,
তার কি তবে একটা চড় বকেয়া থেকে গেল – সামনে ট্রেন যখন প্রায় হাওয়া বাতাসের তফাত সে
হঠাৎ একটা ছোট লোহার পোলের মত জিনিসকে ধরে তাতে যেন জড়িয়ে গেল। তার রোগা বুকটা
সজোরে পোলের সাথে ধাক্কা খেল, সাথে সাথে রিকশাওয়ালাটা তার জামাটা খামচে ধরল পিছন
থেকে, তারপর হাত – তারপর একনাগাড়ে সহস্র মানুষের কথা – সন্ধ্যার গাছগাছালির গায়ে
ছম ছম করতে থাকা পাখিদের মত বাজতে থাকল, কানের আওয়াজ প্রায় বন্ধ হয়ে গেল, তারপর
হঠাৎ সে নিজেকে খুঁজে পেল একটা গলির ভিতর, সম্বিত হারানো কাকে বলে, তা নতুন করে
জানল আবার, আরবার, বার বার এমনি কি সে জেনেছে এটা? দরজার কাছে গিয়ে আস্তে কড়া নাড়ল
– একটা ছিপছিপে মেয়ে বেরিয়ে এসে
বলল “ও ম্যাডাম? আসুন” একতলার ঘরে ঢুকল আঞ্জিনা – মেয়েটি বলল, “দাদাবাবু বেরিয়েছেন আসতে দেরি হবে।”
রাতের ভাবনার মধ্যে তবে এটাই আঞ্জিনার শেষ
উপায় ছিল – এখন সে সরকার’দার জন্য অপেক্ষা করবে, আর খুচরো পত্রিকা নয় এবার একটা বই
যদি তার বের হয় – অগুনতি তামাটে লেখা তার ব্যাগের ভিতর, সরকার’দা যেখানে কাটতে
বলবেন সে কাটবে। যদি কিস্তিতে লিখতে বলে, আত্মকথা লিখবে না সে, তমালীদের কথাই
লিখবে। এই গলিটার শেষেই মহিলাদের অফিস, সারাটা দিন সে সেখানেই এসে কাটিয়ে যাবে।
সরকার’দাকে নিজে থেকেই বলবে এবার, “হাতে আর টাকা নেই, আপনাদের দলে আমার নামটা
লিখিয়ে নিন” কথাটা মাথার ভিতর আসতেই – কে যেন সপাং করে চাবুক চালালো। ধারেকাছের কোনো একটা ঘর থেকে হারমনিয়াম ঘুম নিয়ে ভেসে আসছে
। এখন এর যে কোনো রিডের উপরেই আঞ্জিনার দাঁড়িয়ে যাওয়া চলে।
(চিত্রঋণ : José Fuster)
তুমুল!
ReplyDelete