ব্লক
-“কী ভাই! চিনতে পারো? কেমন
আছো?”
ফেসবুক
মেসেঞ্জারের গোটা দুই নোটিফিকেশন লাফ দিয়ে পড়ল আমার মোবাইলের ডিসপ্লের উপর। আমি
নামটা চিনতে পারলাম না। তারপর তো ভালো থাকা বা না থাকার প্রশ্ন! স্পষ্ট জানালাম।
-“না। ঠিক চিনতে পারলাম না তো!”
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে উত্তর
আসে।
-“কোলকাতা! কবিতার কর্মশালা!
মনে পড়ছে না?”
আমি লিখলাম- “কবে বলো তো?”
-“বছর দশেক আগে”। প্রায় সঙ্গে
সঙ্গেই উত্তর।
আঙুল না যন্ত্র!
এতো স্পিড! একসময় আমি কবিতা টবিতা লিখতাম ঠিকই। কিন্ত কোন কর্মশালার কথা সেভাবে
মনে করতে পারছি না। কিন্তু কোলকাতা বেশ কয়েকবার গিয়েছিলাম কবিতাকে কেন্দ্র করে। হবে
হয়ত কোন এক সময় এর সাথে যোগাযোগ হয়েছিল।
আমারই হয়ত মনে নেই। কিন্তু এই লোকটা এতো বছর ধরে ব্যাপারটা মনে রেখেছে ভেবে
কৌতুক বোধ করলাম। আর আগে যদি যোগাযোগ নাও হয়ে থাকে এখন তো হলো! মেসেঞ্জার জানাচ্ছে- “নাউ ইউ এন্ড
রাজীব আর ফ্রেন্ডস।“ বেশ তাই হোক!
ব্যাপারটা
এই পর্যায়ে থাকলে কোন অসুবিধা ছিলনা। সমস্যা হলো আমার এই নবাগত বন্ধুর বর্তমান
নিয়ে কোন কথা নেই। সব কথা, সব আলাপ দশ বছর আগের বিষয় নিয়ে। আমরা নাকি তিন দিন ঐ
কর্মশালায় ছিলাম! এবং ঐ তিন দিন আমাদের সঙ্গে আরো এক বন্ধু ছিল। তার নাম নাকি
প্রমিত! সব সময় নাকি আমরা একসঙ্গে থাকতাম! এক সঙ্গে লাঞ্চ করতাম। কর্মশালার পর
আমরা কোথায় কোথায় ঘুরতে যেতাম, হুবহু ধারা বিবরণী দিয়ে যাচ্ছেন আমার এই নবাগত
বন্ধু!
-“মনে আছে ভিক্টোরিয়া দেখার
দিনটা? সেই যে মেঘলা দিন! মাঠে হোঁচট খেয়ে তুমি পড়ে গিয়েছিলে!... একদিন তোমার
গ্যাসের ব্যথা উঠল! আমি অনেক দোকান খুঁজে ট্যাবলেট এনে দিলাম!...”
অনবরত চেষ্টা করে যাচ্ছেন আমার এই বন্ধু। যদিও
কিছুই আমার মনে পড়ছিল না। এ যেন প্রতিজ্ঞা করেছে, আমাকে মনে করিয়ে ছাড়বেই।
আমি
এখন কেমন যেন এক আতঙ্কের মধ্যে পড়ে গেছি। নেট অন করলেই ঝাঁকে ঝাঁকে মেসেজ বন্দুকের
গুলির মত উড়ে উড়ে আসে। আমি ‘হ্যাঁ’, ‘ও’, ‘আচ্ছা’, ‘বাহ’ প্রভৃতি বলে দায়সারা
উত্তর দিতে থাকি। কী আর করব! এই দুর্ভোগও আমার কপালে ছিল! তবে আমিও এখন
নাছোড়বান্দা। এর শেষ দেখে ছাড়ব।
সেদিন
অনলাইনে একটা ওয়েব ম্যাগাজিন পড়ছিলাম। বাংলা কবিতা আর সিনেমা নাকি একই সঙ্গে
পাল্লা দিয়ে পিছনের দিকে এগোচ্ছে। বাংলা কবিতাই নাকি এখন একমাত্র কুটির শিল্প! আর
বাংলা সিনেমার গোয়েন্দাপ্রীতির কারণ অনুধাবন করতে নাকি গোয়েন্দা লাগাতে হবে। ইন্টারেস্টিং লাগছিল
লেখাটা। দুম করে মেসেজ।
-“আরে তোমার প্রমিতের কথা মনে
আছে?”
মেজাজ চিড়বিড়িয়ে উঠল। মিথ্যা বললাম।
-“হ্যাঁ। কেনো?”
-“কিছুনা। ও কেমন আছে জানতে চাইছিলাম
আরকি!”
-“খুব ভাল আছে প্রমিত। তোমার
কথা খুব বলে।“ আবারো ঢপ ছাড়লাম।
-“আসলে ওকে এফবিতে খুঁজে
পাচ্ছিনা। সম্ভব হলে ওর ফোন নং টা দিও তো!”
-“ঠিক আছে”।
ঘটনা
হলো ধীরে ধীরে আমার কিন্তু ব্যাপারটা ভাল লাগতে শুরু করেছে। রাজীবের সঙ্গে যতক্ষণ
আমার মেসেজিং হয় আমি অন্য একটি চরিত্রে ঢুকে যাই। অভিনয় করি। আবার মাঝে মাঝে এও
মনেহয়, হতে পারে সত্যি সত্যি আমি রাজীব আর প্রমিত কোন এক সময় কোলকাতার কোথাও মিলিত
হয়েছিলাম! এমন তো হতেই পারে আমার মনে নেই! ওর মনে আছে! প্রমিতটাকে পেলে ভালো হত।
ওর কাছ থেকে আসল ব্যাপারটা জানা যেত। কিন্তু প্রমিত বলে কারো সঙ্গে
আমার দেখা হয়েছিল এমন মনে পড়ছে না। অমিত নামে এক বন্ধু আছে। কলকাতায় থাকে।
ওকে রাজীবের নাম বলতেই সরসরি ‘চিনিনা’ বলে ঠোঁট ওল্টাল।
একদিন স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলাম।
-“আচ্ছা, আমি কি তোমাকে রাজীব
নামে কোন বন্ধুর নাম কখনো বলেছি, যার সাথে কোলকাতার কোন কবিতা কর্মশালায় বা
সেমিনারে দেখা হয়েছিল?”
-“না তো! কেন বলো তো?” রাতে
শোয়ার আগে মুখে ক্রিম ঘষতে ঘষতে মিলি অন্য দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল।
-“না। এমনি।“
কয়েকদিন পর
রাজীব আমাকে পুরোপুরি চমকে দিল। সকাল দশটা নাগাদ মেয়েকে নার্সারি স্কুলে পৌছে দিয়ে
চলে যাই আমার কর্মস্থলে। টিচার্স রুমে বসে আছি পাখার নিচে। প্রেয়ার শেষ হবার পর এখনো ক্লাশের ঘন্টা পড়েনি। দিনে
প্রথম বারের মত মোবাইলে নেট অন করলাম। যথারীতি রাজীবের মেসেজ। ও জানতে চেয়েছে,
শর্মিষ্ঠা এখন কেমন আছে। সম্পর্কটা এখনো আছে কিনা।
এবার মোক্ষম চাল
দিয়েছে রাজীব। রাজীবের তো শর্মিষ্ঠাকে চেনার কথা নয়! আমি সমস্যায় পড়ে গেলাম। তবে
কি আমার কলেজ লাইফের কোন বন্ধু! ছদ্মনামে আমার সাথে ইয়ার্কি করছে! নেট অফ করে
দিলাম রিপ্লাই না দিয়েই।
দিন সাতেক আর কোন মেসেজ আসেনি রাজীবের। আমি যেন
মুক্তি পেলাম। মাস খানেক পর একদিন হঠাৎ রাজীবের উদয়।
-“কেমন আছো?”
-“ভালো। এতদিন কোথায় ছিলে?”
-“সমস্যায় আছি বন্ধু”।
-“কী সমস্যা?”
-“আমার এক্সিডেন্ট হয়েছে।
হাসপাতালে ভর্তি”।
-“কী বলছো? কীভাবে হলো?”
-“বাইকে... ডান পা ফ্রাকচার”
কিছুক্ষণ পর আবার রাজীবের মেসেজ।
-“একটা কথা রাখবে?”
-“কী? বলো! ”
-“তোমার সাথে একবার দেখা হওয়া
সম্ভব? একবার আসতে পারবে?”
আমি তো হতভম্ব। বলে কী! তবু দ্বিধা নিয়ে জানতে
চাইলাম।
-“তুমি কোন হাসপাতালে আছো?”
-“কল্যাণী। জে. এন. এম.
হাসপাতালে। সিট ন. ৩৫। মেল মেডিকেল ওয়ার্ড। আসতে পারবে?” কথাগুলোয় এতো মায়া জড়ানো
যে তখন না বলতে পারলাম না।
-“হ্যাঁ। অবশ্যই যাবো। তা
তোমাকে এখন দেখাশোনা করে কে?”
-“ আয়া”।
-“ফ্যামিলি?”
-“নেই”।
-“কেন?”
-“হয়ে ওঠেনি। এই বয়সে সম্ভবও
নয়। এখানে আমি একাই থাকি। স্থানীয় একটা অসুধের কারখানায় কাজ করি। চলে যায় একার
জীবন”।
-“বাবা মা নেই?”
-“আছে। বীরভূমে। ওখানেই আমার
দেশের বাড়ি। কল্যাণীতে ভাড়া থাকি”।
‘দেশের বাড়ি’ শব্দ দুটোয় কান আটকে গেল। সত্যি বড়
একা মনে হচ্ছে রাজীবকে। একবার অবশ্যই যাওয়া উচিত।কথা দিলাম আগামী রবিবার রাজীবকে
দেখতে যাবো।
কিন্তু রবিবার সকাল থেকে মন দ্বিধায় ভরে উঠল।
জানা নেই, শোনা নেই, এভাবে একজন অপরিচিতকে দেখতে আমাকে এই ক্যানিং থেকে কল্যাণী
ছুটতে হবে! ট্রেন বাস অটো মানুষের ভীড় ঠেলে! কে রাজীব! যার জন্য আমার কাঙ্ক্ষিত
ছুটির দিনটা ব্যয় করতে হবে! রবিবার তো আমরা সপরিবারে ঘুরতে বেরই! পার্ক সিনেমা
খাওয়া দাওয়া নিয়ে মহা ফুর্তির দিন! নিকট কেউ হলে নাহয় ঠিক আছে। কিন্তু যাকে আমি
চিনিই না তাকে দেখতে যেতে হবে!
ধরে
নিচ্ছি আমিই সেই ব্যক্তি, রাজীব যাকে খুঁজছে। কোন কারনে যোগাযোগ নষ্ট হয়। ফেসবুকের
কল্যাণে আবার পরিচয়। কিন্তু মাঝখানে অনেক গুলো বছর। রাজীবের কথায় প্রায় দশ বছর।
আমি কি সেই আগের মানুষ আছি! আগে ব্যাচেলার ছিলাম। এখন বিবাহিত। আগে কবিতা লিখতাম।
এখন লিখিনা। আগে চোখে মুখে ভরে থাকত শর্মিষ্ঠার ঘোর। এখন আমার পাশে একি বিছানায়
মরা মানুষের মত ঘুমায় আমার স্ত্রী। মাঝে ছোট্ট মেয়ে। নরম হাতে সারারাত আমার গলা
জড়িয়ে থাকে। আমি তো বদলে গেছি সম্পূর্ণ ভাবে। সেই খ্যাপা যুবক তো নই, যে স্বপ্ন
দেখত কবিতা লিখে বিশ্ব জয় করবে!
রাজীব
আসলে খুবই বোকা। ওর কাছে প্রমিত আমি সকলেই হয়ত সমান। ও একা থাকে। তাই ওর বন্ধু
প্রয়োজন। যার সাথে ওর অতীত শেয়ার করতে পারবে। তাই হয়ত ভুল করে আমাকে খুঁজে বের
করেছে। আমার নামে তো ফেসবুকে শয়ে শয়ে মানুষ আছে। ও হয়ত চাইছে কোন সমব্যথী। যার
মধ্যে ও নিজেকে আবিষ্কার করতে পারবে। নিজেকে দেখতে পাবে। আবার এমনও হতে পারে, রাজীব
এতোদিন নিজের সাথেই কথা বলছিল! আমি প্রমিত ছিলাম উপলক্ষ্য মাত্র!
সেইদিন আমি রাজীবের কাছে যাইনি। সেদিন সন্ধ্যায়
রাজীবকে আমি ব্লক করে দিয়েছিলাম।
(চিত্রঋণ :
René Magritte)
রাজীবরা একা থাকে। নিজের ভেতরে একা। এরা বন্ধু চায়। একাকিত্বের সঙ্গী চায়। আর আসলে একা থাকা মানুষরা, যারা যৌথজীবনের অভিনয় করে তারা দৃশ্যত একাকী মানুষদের থেকে সরে সরে যায়। আসলে আরও একা হয়ে যায়। আমি ঠিক এই জায়গা থেকে গল্পটা দেখছি।
ReplyDeleteএবং আমার বেশ ভালো লেগেছে।
aponatei golpo posha, besh bhalo laglo dada...aro onek golpo porte chai, ajker dine ei golpo ti khub prasongik... ami emon promit k chini.. rajib keo chini.. vugche sobai..
ReplyDeleteValo laglo
ReplyDeleteValo laglo
ReplyDeleteaapni thakchen sir
ReplyDelete