বাক্‌ ১০৯ :: খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে :: প্রদোষ পাল




‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে’


জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নীৎসে ৩রা জানুয়ারি ১৮৮৯-এ তুরিন শহরে একবার দ্যাখেন একজন বুড়ো কোচওয়ান একটি ঘোড়াকে চাবকাচ্ছে। ঘোড়া কিছুতেই নড়তে চাইছে না। আর কোচওয়ান চাবকেই চলেছে। নীৎসে তখন কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন। তিনি ছুটে যান এবং তাঁর পিঠেও চাবুক পড়তে থাকে। এর পর নীৎসে সম্পূর্ণভাবেই মানসিক ভারসাম্য হারান। মানসিক হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হয়। দু বছর পর তাঁর মৃত্যু হয়। এ ঘটনার কথা অনেকেই জানেন নিশ্চয়ই। এখান থেকেই সিনেমাটির সৃষ্টি।
       একটা বুড়ো ঘোড়া আর তার বুড়ো কত্তা প্রচন্ড ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়া ও কুয়াশা ভেদ করে নির্জন পাহাড়ি গ্রাম্য পথ বেয়ে এগিয়ে চলেছে। সঙ্গে একঘেয়ে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। দুপাশে কাঁটার ঝোপঝাড়। পর্দাজুড়ে বুড়ো ঘোড়ার প্রকান্ড মুখ। ক্যামারাকে ধরা হয়েছে নিচ থেকে। বুড়োকত্তার মুখ দূর পরিপ্রেক্ষিতে ছোটো পরণে কালো জোব্বামুখ ঢাকা নেই। হিমেল হাওয়ায় চুল এলোমেলো। ধুলিঝড়ের মধ্যে কখনো কখনো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, আবার জেগে উঠছে। জনমানবহীন রাস্তা। দুলকি চালে ঘোড়ার গাড়ি চলছে তো চলছে তাল মিলিয়ে ঐ ঘ্যানঘ্যানানি সুরঘ্যানঘ্যানানি? ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি আমার পাওয়া সেরা ব্যাকগ্রাউন্ড সুরসিনেমা নিয়ে সামান্য স্মৃতি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যদি অক্ষত থাকে তবে এই সুরটি যেন শুনতে পাই এ সুর এককথায় অনন্তের সুর। হারিয়ে যাওয়ার সুর। ঈশ্বরের পায়ে সমর্পণ করার সুর। দৃশ্যটাও তো তাই অভিব্যক্তিহীন বুড়ো কোচওয়ান চলেছে তো চলেছে কোনো অনন্ত পথের পথে। ২০১১তে নির্মিত এই ছবিটি সাদাকালো। শুধু সময়কে ধরা নয়, সাদাকালো দিয়ে কত কথা যে বলা হয়েছে তা ভাষা দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। সঙ্গে ঐ একঘেঁয়েমি সুর কোথায় কোন অনন্তে যে নিয়ে চলে গ্যাছে, সেটা বা বোঝাই কী করে! 


     প্রায় ছ সাত মিনিট এমন চলা দৃশ্যায়নের পর বাড়ির কিছুটা দূরে বুড়োকত্তা ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে বাড়ি পর্যন্ত ঘোড়ার জিন ধরে গাড়িকে টেনে নিয়ে গেল। হয়তো ও পথে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। বাঁ হাতে ঘোড়ার জিন ধরে টানতে দেখা গেল বুড়োকে। বোঝা গেল বুড়োকত্তার ডান হাত অকেজো। শরীরের সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে। বাঁ হাতেই সব করতে হয়। ত্রিসীমানায় অন্য কোনো বাড়ি ঘর, মানুষজনের দেখা নেই।        
        দূরের মাঠ থেকে ছুটে এল একজন নারী, বয়স তিরিশের কোটায়। সম্ভবত বুড়োকত্তার মেয়ে। ঝোড়ো হিমেল হাওয়ায় তারও চুল উথাল পাথাল। পঙ্গু বাবাকে সাহায্য করতে তাড়াতাড়ি ঘোড়ার জিন নিজের হাতে নিয়ে বাবাকে মুক্ত করলো। গাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ঘোড়াশালের বিশাল কাঠের দরজা খুলে ঘোড়াকে ভেতরে নিয়ে গেল। আর একটা বিশাল কাঠের ভাঙাচোরা দরজা খুলে ভেতরে রাখা হলো গাড়িটা। ঘোড়াকে খড় বিচালি দেওয়ার পর কাঠের খিল লাগিয়ে বাবাকে ঘরের ভেতর নিয়ে গেল।   

    
        কারো কোনো কথা নেই। বাইর থেকে পরে আসা বাবার গাম্বুট  খুলে, ঘরে পরা বুট জুতো পরালো। বাইরের পোশাক বদলে ঘরের পোশাক পরিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। ঘরের একপাশে উনুনে কাঠের আগুন জ্বলছিল একটা পাত্রে ফুটছিল গরম জল, তার থেকে কিছুটা গরম জল অন্য একটি পাত্রে নিয়ে দুটো বড় আকারের আলু সেদ্ধ করতে বসাল মেয়েটি। আলু সেদ্ধ হতে থাকে, উনুনের পাশের জানালা দিকে তাকিয়ে চুপকরে বসে থাকতে দেখা যায় মেয়েটিকে সঙ্গে মৃদুস্বরে সেই ঘ্যানঘ্যানানি সুর। ক্যামেরাকে ধরা হয়েছে মেয়েটির পেছন থেকে। কাঁচের জানালার বাইরে ঝোড়ো হাওয়া বইছে তো বইছেকী ভাবছে মেয়েটি? ফেলে আসা অতীতের কথা? নাকি ভবিষ্যতের কথা? দেখতে মোটেই সুশ্রী নয় সেকেউ জানেনা তার অতীত কি ছিল! ভবিষ্যতেও যে বিশেষ কিছু অপেক্ষা করছে তা অন্তত দেখে বোঝা যাচ্ছে না। বেশ কিছুটা সময় বসে থাকার পর একটি কাঠের হাতা দিয়ে পরীক্ষা করে দেখল আলু সেদ্ধ হয়ে গ্যাছে আলু দুটোকে অন্য একটি পাত্রে রেখে খাবার টেবিলে রাখল। সঙ্গে রাখল দুটো কাঠের প্লেট ও নুনের কৌটো। ‘ইটস রেডি’। শুধু একটা কথা। বাবাকে লক্ষ্যকরে এই প্রথম তার কথা। ছবিতে কারও কথাও এই প্রথম শোনা গেল।  

              
     নিঃশব্দে বাবা খাবার টেবিলের পাশে বসলো। গরম আলু  থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। বাবা গরম আলুর খোসা ছাড়াতে লাগল দ্রুত হাতে। আলুর ওপর বাঁ হাতের বাড়ি মেরে আলু থেঁতো করলো, যাতে তাড়াতাড়ি আলু ঠান্ডা হতে পারেবোঝা যাচ্ছে বুড়োকত্তার খুব খিদে পেয়েছে। হু হা করতে করতে গরম আলু খেতে লাগল। ক্যামেরাকে ধরা হয়েছে বুড়ো কত্তার সামনে থেকে ক্লোজ-আপে ডান হাত অকেজো, বাঁ হাত দিয়েই খেতে থাকলকিছুক্ষন পর বুড়োকত্তা উঠে মেয়ে যেখানে জানলার পাশের টুলে বসেছিল, সেখানে গিয়ে বসল একই ভাবে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকল জানালার বাইরে। এবার ক্যামেরা ধরল মেয়েটিকে। সে কিন্তু ধীর স্থির। আস্তে আস্তে আলুর খোসা ছাড়িয়ে খেয়ে চলেছে বাবার খাবার প্লেটে ক্যামেরা তাক করতে দেখা গেল বুড়ো কত্তার খিদে যতই পাক, পুরোটা খায়নি। প্লেটে পড়ে রয়েছে অনেকটাই ছাড়ানো আলু। মেয়েটি নিজেও পুরোটা খায়নি। হয়তো খেতে পারেনি! হয়তো রোজই তাদের শুধু আলুসেদ্ধই খেতে হয়। মুখে রুচে না, তবুও না খেয়ে উপায় নেই। দুটি প্লেটের অবশিষ্ট আলু একত্র করে ঘরের কোনে রাখা পাত্রে ফেলে দিল   
     রাত হলো, প্রথম বাবার কথা শোনা গেল ‘বিছানায় যাও’অবাধ্য মেয়ের মতো মেয়েটি আলো নিভিয়ে কিছুক্ষনের মধ্যেই বিছানায় চলে গেল পর্দা জুড়ে অন্ধকার।

        
       এতক্ষন হুবহু বর্ণনা দিলাম। বিশেষ কিছু মনে হলো কী? পরিচালক প্রতিটি দৃশ্য খুবই নিখঁতভাবে সময় দিয়ে দেখিয়েছেন যেমন, জিন থেকে ঘোড়াকে মুক্ত করে ঘোড়াশালের দরজা খুলে গাড়ি ও ঘোড়াকে রাখতে যতটা সময় লাগে ঠিক ততটা সময় দিয়েই দেখানো হয়েছে। একজনের জামা প্যান্ট পরতে বা কাউকে পরাতে যতটা সময় লাগে ততটা ধরেই দেখানোআলু সেদ্ধ হতে যতটা সময় লাগে ঠিক ততটা। পরিচালক হয়তো শুধু দেখাতেই চেয়েছিলেন। বোঝাতে কি চেয়েছিলেন কিছু?

 
         সকাল হলো। পর্দায় দেখানো হলো ‘দ্বিতীয় দিন’। একটি কাঠের বালতি নিয়ে মেয়েটি চলল কুয়ো থেকে জল আনতে। বাইরে তুমুল ঝোড়ো হাওয়া। জল নিয়ে ঢুকতে বাবা তাকাল মেয়ের দিকে। খুব অসহায় সে তাকানো। তার পঙ্গুত্ব হয়তো মেয়েকে সাহায্য করতে পারছেনা বলে অসহায়তা বাবার প্যান্ট, জামা জুতো একে একে আবার পরিয়ে দিল মেয়েটিদুজনে বাইরে এসে ঘোড়াশাল থেকে ঘোড়া আর গাড়ি বাইরে বের করে আনল। ঘোড়ার জিন পরিয়ে বুড়োকত্তা গাড়ি চালাতে চাইলেও ঘোড়া স্থীর দাঁড়িয়েই থাকল। বুড়ো চাবুক চালাল, তবুও ঘোড়া নড়ল না। এক সময় বুড়োর ধর্য্যের বাঁধ ভাঙল। পাগলের মতো চাবুক চালিয়ে ঘোড়ার গাড়ি চালাতে চাইলেও শেষে হার মানতে হলো। কিছুতেই ঘোড়া নড়ল না। 


     হাঙ্গেরীর পরিচালক বেলা তারের জীবনের শেষতম এই ছবি ‘তুরিন হর্স’(২০১১)এমন কিছু বয়স হয়নি পরিচালক বেলা তারের। জানা গেল ‘তুরিন হর্স’ করার সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৫ বছর। তবুও তিনি এমন উচ্চ মানের ছবি করার পরও পরিচালনা থেকে সরে এলেন! কেন? আসলে এ ছবি এমন এক স্তরে পৌঁছনোর ছবি, যার পর বোধহয় আর যাওয়ার জায়গা থাকে না। ঈশ্বরের চরণে যেন সব উজাড় করা নিবেদন। যদিও এ আমার ভাবনা। ছবিটি দেখে সেটাই মনে হয়েছে। যে চলচ্চিত্র উৎসব কে সারা পৃথিবী মান্যতা দেয়, সেই ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব থেকে পুরস্কৃত হওয়ার পরও কারো সিনেমা পরিচালনা ছেড়ে দেওয়া খুব সাধারণ ব্যাপার নয়। ছবি শুরুর আগে বেলা তার কয়েকটি কথা বলেছেন,  "In Turin on 3rd January, 1889, Friedrich Nietzsche steps out of the doorway of number six, Via Carlo Alberto. Not far from him, the driver of a hansom cab is having trouble with a stubborn horse. Despite all his urging, the horse refuses to move, whereupon the driver loses his patience and takes his whip to it. Nietzsche comes up to the throng and puts an end to the brutal scene, throwing his arms around the horse’s neck, sobbing. His landlord takes him home, he lies motionless and silent for two days on a divan until he mutters the obligatory last words, 'Mutter, ich bin dumm!' ['Mother, I am stupid!' in German] and lives for another ten years, silent and demented, cared for by his mother and sisters. We do not know what happened to the horse."
     কি বোঝা যায় এ কটি কথা থেকে। আসলে কিছুই কি তিনি বোঝাতে চেয়েছেন? এ ছবি বোধহয় বোঝার নয়, দেখার। আর দেখতে দেখতে এমন কিছু অনুভূতি হয় যখন চেনা জগতকে অচেনা মনে হয়। চোখের পলক পড়ে না। তুরিন নাকি এমন একটি জায়গা যেখানের তাপমাত্রা শীতকালে মাইনাস ১০ বা ১২ ডিগ্রী থাকে, কিন্তু সেখানে তুষারপাত হয় না। বুড়ো কোচওয়ান ও তার মেয়ে এমন একটা জায়গায় থাকে যেখানে সব সময় প্রচন্ড হিমেল হাওয়া বইছে। ঠান্ডা কতটা তা পোশাক আশাক দেখলেই বোঝা যায়।   
     আর একটু ঘটনায় ফেরা যাক। বাবা মেয়েতে আবার ঘোড়াশালে ঘোড়া গাড়ি ঢুকিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করল। রাগের বঃহিপ্রকাশ দেখিয়ে বুড়োকত্তা নিজেই জামা জুতো খুলে ফেলতে চাইলেও পারল না। মেয়ের সাহায্য নিয়ে পোশাক বদলে উনুনের কাঠ চিরতে লেগে পড়ল। রাগের যত বহিঃপ্রকাশ যেন ধরা পড়ল কাঠ চেরাইয়ের মধ্যেতবে দৃশ্যটি মনে রাখার মতো। বাঁ হাতে কাঠের দন্ড কে সোজা বসিয়ে কুঠার দিয়ে এক এক কোপে দু ফাঁক করে ফেলা যে কতটা মুন্সীয়ানা, কতটা অভ্যাস, সাধনার প্রকাশ, না দেখলে বিশ্বাস হয়না। ক্যামেরার চাতুরিহীন সরাসরিই দেখানো হয়েছে পুঙ্খানুপুঙ্খ      
    
      আবার ক্লান্তিকর আলু সেদ্ধ। বাইরে ক্রমাগত বয়ে চলা ঝোড়ো হাওয়া। এই প্রথম তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে তাদের দরজায় কড়া নাড়াতে দেখা গেল। সে এসেছে ব্র্যান্ডি কিনতে। বোঝা যায় ব্র্যান্ডি বিক্রি করেও কিছুটা রোজগার হয় তাদেরব্র্যান্ডি কিনতে আসা ব্যক্তিটি টেবিলের একপাশে বসে অনেক জ্ঞ্যানের কথা বুড়োকে শুনিয়ে গেল। সবই অধ্যাত্মবাদের কথা। বুড়ো অবশ্য ‘রাবিশ!’ বলে তাকে খারিজও করে দিল।        
     তৃতীয় দিনের সকাল। আবার কুয়ো থেকে জল আনাবাবার পোশাক পরানো। ঘোড়াশালে গিয়ে দেখল সে একটুও কিছু খায় নি। অভিমানে মুখ নিচু। বাপ বেটি বুঝল আজও তার বাইরে যাবার ইচ্ছে নেই। জোরাজুরিও করলো না কেউ। আবার আলু সেদ্ধ খাওয়া। খেতে খেতে জানলা দিয়ে বুড়ো দেখতে পেল তাদের বাড়ির দিকে অনেক মানুষজন ভর্তি একটি ঘোড়ার গাড়ি আসছে। মেয়েকে এগিয়ে গিয়ে দেখতে বলেবোঝা গেল তারা তাদের কুয়ো থেকে জল খেতে এসেছে। মেয়েটি তাদের চলে যেতে বললেও তারা যাচ্ছিলনা। উল্টে তারা মেয়েটিকে আমেরিকা নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয় ও টানাটানি করতে থাকেশেষে বুড়ো কত্তা কুঠার নিয়ে তাড়া করাতে তারা পালায়। পালানোর আগে একজন বয়স্ক মানুষ মেয়েটিকে একটি বাইবেল দিয়ে যায়, জল খাওয়ানোর পুরস্কার হিসেবে। 


   কাজের ফাঁকে মেয়েটি আধো আধো ভাবে বাইবেল থেকে কয়েকটা লাইন পড়তে থাকে। আগের দিনের ব্র্যান্ডি কিনতে আসা ব্যক্তিরই প্রতিধ্বনি যেন ঐ বাইবেলে। যা তাদের জীবনের মর্মকথা। ছবিরও। ...The lord was with you! Morning will become night, night will be an end...
       চতুর্থ দিন সকালে কুয়ো থেকে জল আনতে গিয়ে মেয়েটি দেখল এক আশ্চর্য ঘটনা। ছুটে এসে বাবাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে দেখাল একফোঁটা জল নেই কুয়োতে। পড়ে রয়েছে শুধু পাথর। ঘোড়াশালে গিয়ে দেখল, ঘোড়া একটাও দানা খায়নি। কি করুণ তার মুখ। বুড়ো সিদ্ধান্ত নিল আর এখানে থাকা যাবেনা। সমস্ত জিনিস একটা গাড়িতে তুলে দূরে কোথাও যেতে চাইল। সঙ্গে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো ঘোড়াটিকেযদিও আবার ফিরে এল তারা। কেন কে জানে! হয়তো পালাবার পথ নেই।  
      এরপর কাটল পঞ্চম, তারপর ষষ্ঠদিন। একই ভাবে। জল নেই। বাতির তেল ভরা থাকলেও বাতি জ্বলতে চায় না। শেষ দৃশ্যে খাবার টেবিলে আবার বাবা মেয়েতেআলু সেদ্ধর প্লেট নিয়ে চুপচাপ বসে। বাবা একটু খেলেও মেয়েটি চুপ করে বসেই থাকল। বাবা যদিও বলল ‘উই হ্যাব টু ইট’, তবুও মেয়ে একদানাও মুখে তুলল না। আস্তে আস্তে অন্ধকার নেমে এলছবি শেষ

    
     খুব মনে পড়ে নজরুলের সে গানটা- ‘খেলিছ এই বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা, নিরজনে প্রভু নিরজনে’
    এই বিশাল পৃথিবীতে আমাদের কত আস্ফালন। ধর্মের নামে, ক্ষমতার নামে কত বজ্জাতি। কিন্তু ওই বিরাট শিশুর কাছে কি আমাদের মূল্য? আমরা তো পুতুল মাত্র। ঐ যে কোচওয়ান বুড়ো আর তার মেয়ে প্রতি নিয়ত প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে চলছে। জানেও না কেন তারা বেঁচে রয়েছে। বাকি জীবনে বেঁচে থাকার কী তাদের উদ্দেশ্য! তবুও এভাবেই বেঁচে রয়েছে। এমন কত লক্ষ লক্ষ মানুষ নিত্য এমন প্রতিকুলতার যুদ্ধে টিকে রয়েছে, টিকে থাকতে চাইছেতারাও জানেনা কেন কী জন্য বেঁচে আছে। কত চেনা, দেখার ঘটনাও যে কেউ এভাবে দেখাতে পারে, কত অপ্রয়োজনের প্রয়োজন’কে এ্যাতো সহজ করে বলতে পারে, তা তো ভাবিনি!

শিল্পী : প্রদোষ পাল
       
     এ ছবির সন্ধান কেউ আমাকে দেয়নি। বেলা তার যে কে সেটাই জানতাম না। ভালো ছবির সন্ধান যে ভাবে করি সেভাবেই একদিন খুঁজে পেলাম ‘তুরিন হর্স’ পরে জেনেছিলাম ২০১১তে নাকি কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়েছিল। যেহেতু ঐ উৎসব নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা আমার নেই, তাই জানতে পারিনি। এমন মানের একটি ছবি নিয়ে কারো লেখাও চোখে পড়েনি। ২০১৩ তে প্রথম দেখার পর বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। এ্যাতো গতিময় পৃথিবী, এ্যাতো তার চাহিদা। এককথায় তার প্রয়োজনের শেষ নেই। শব্দদাণবের প্রচণ্ড দাপটে কান বলে যে শরীরের একজোড়া অঙ্গ রয়েছে তা ভুলতে বসেছি। দৃশ্যদূষণ তো কহতব্য নয়। তেমন সময়ে এরকম একটা ছবি, এরকম তার সুর, কিছুতেই যেন মেলাতে পারছিলাম না। তখন সবে ফেসবুকে এসেছি। বেশ কয়েকবার এ ছবির কিছু ইমেজ পোস্ট করেছিলাম। লেখার কথা ভাবিনি। নিজেকে প্রকাশ করার এ্যাতোটা যে সুযোগ পাবো তাও জানতাম নাভালো লাগছে আজ তার কথা বলতে পারলাম। যদিও কিছুই বলতে পারলাম না। এ তো বলার ছবি নয়, এ ছবি দেখার, অনুভবের।

শিল্পী : প্রদোষ পাল
              

9 comments:

  1. অসামান্য ছবির অতুলনীয় বর্ণনা।

    ReplyDelete
  2. অসামান্য ছবির অতুলনীয় বর্ণনা।

    ReplyDelete
  3. আধুনিক চলচ্চিত্রের এক মহত্তম অনুভূতি প্রকাশিত হয়েছে এই হাঙ্গেরিয়ান ছবির মধ্যে দিয়ে। পরিচালক ‘বেলা তার’ এক অন্তর্লীন স্রষ্টার চোখ দিয়ে সেলুলয়েডে একটা গভীর নান্দনিক টেস্টামেন্ট রেখেছেন এই সিনেমার মধ্যে দিয়ে। আপনার এই মনোজ্ঞ প্রতিবেদন পড়ে ২০১২ সালে নন্দনে প্রথম দেখে তড়িৎপৃষ্ঠ হবার অভিজ্ঞতাটা আবার মনে পড়ে গেল।

    ReplyDelete
  4. খুব ভালো আলোচনা করেছেন প্রদোষবাবু। খুবই ভালো। যদিও আপনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, তবু আমার মতো করেই বলি, শিল্পের কোনো শাখারই মানে বই বা নোট বই হয় না। প্রাথমিক শর্তই হল অনুভব। একদম ভেতর থেকে অনুভব। আপনিও সেই অনুভবকেই জানিয়েছেন শব্দে শব্দে। এবং বলাবাহুল্য, বেশ ভালো লেগেছে। অনেকক্ষেত্রেই যেন সেই অনুভব আমাকেও জারিত করছে। ভেতরে রিনরিন অনুভব করতে পারছি।

    ReplyDelete
  5. বাচন ভঙ্গিটি এতটাই সুন্দর যে ছবিটি ও তার বক্তব্যকে উপলব্ধি করতে যেন সাহায্য করলো ।

    ReplyDelete
  6. অসামান‍্য সিনেমাটির আখ‍্যান,আপনার লেখার শৈলীটায় একটা মুগ্ধতা আছে যা পড়ত আগ্ৰহী করে...আপনার আঁকা ছবি গুলোও অসামন‍্য।

    ReplyDelete
  7. Bela Tarr r sathe prothom porichoy Satantango te. Cinemar soundorjye hotobak hoye gechhillam. 7 hr r cinema, tobu aktuo klesh nei, ki sabolil tar vongi, ki sabolil chalachitrayan. Bela Tarr mone koriye dyai cinemar adi proyojon r kotha. Tarr k ami akjon darshonik bolei mone kori.

    ReplyDelete